রমজান মাস উপলক্ষে সম্প্রতি ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই অনুষ্ঠান ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই তৈরি হয়েছে জোর আলোচনা। নেটিজেনদের একাংশের অভিযোগ যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো হয় না। কিন্তু ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়। কেউ কেউ লিখেছেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থীরা সরস্বতী পুজো করতে দেয়না কিন্তু আজান দিয়ে ইফতার পার্টি করতে পারে….হিন্দুদের প্রধান শত্রু হলো বামপন্থীরা”।

একই অভিযোগ করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। এক্স হ্যান্ডেলে ইফতারের ভিডিয়ো পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, “এটাই লিব্যারাল বামপন্থীদের মুক্তচিন্তার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র যাদবপুর! বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যেখানে বাগদেবী মা সরস্বতীর আরাধনার কথা হলে ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ ওঠানো সিউডো-সেক্যুলারদের ভ্রু কুঞ্চিত হয় কিন্তু এসব কেবলই ধর্মনিরপেক্ষতা মাত্র! সম্প্রতি বাংলাদেশকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া @AITCofficial পন্থীদের কাছেও বাড়তি অক্সিজেন! সনাতন হিন্দু বিরোধী মতাদর্শ অক্ষুণ্ন রেখে বাম-তৃণমূল অজৈব জোটের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে দেবী সরস্বতীর প্রবেশ নিষিদ্ধ কিন্তু এসবে মুখে কুলুপ!”
Fact check/ Verification
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সত্যি সরস্বতী পুজো, দোলের মতো হিন্দুদের উৎসব হয় না?
এই উত্তর পেতে News Checker-এর তরফে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (ABVP) ইউনিট প্রেসিডেন্ট নিখিল দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি আমাদের জানান, “গত দু’বছর ধরে এবিভিপি-র তরফে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামের উল্টোদিকে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে দোল উৎসবও হয়। কিন্তু, এই সমস্ত অনুষ্ঠান করতে গেলে আমাদের ফ্ল্যাগ, পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়।” সেক্ষেত্রে সরসরি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের দিকে আঙুল তোলেন নিখিল দাস।
ভাইরাল দাবিটিকে ভুয়ো আখ্যা দিয়ে, এক বাক্যে সরস্বতী পুজো আয়োজনের কথা স্বীকার করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP) নেতা তথা গবেষক সঞ্জীব প্রামাণিক। তিনি জানান যে, ২০১২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ও হোস্টেলগুলোতে সরস্বতী পুজো হয়ে আসছে। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (TMCP)। কোভিডের সময়টুকু বন্ধ থাকলেও, ২০২৫ সালেও পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। এমনকী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দোল উৎসব এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে বিশ্বকর্মা পুজো হওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। আরও যোগ করেছেন যে, সরস্বতী পুজোয় যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম পড়ুয়ারা যোগ দেয়, তেমনই ইফতার পার্টিতেও হিন্দু পড়ুয়ারা যোগ দেয়।
২০২৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করতে চেয়ে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তরফে রেজিস্টারের কাছে যে অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল, News Checker-কে সেটাও পাঠান সঞ্জীব প্রামাণিক। যেখানে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ইউনিটের সভাপতি হিসেবে কিশলয় রায়ের নাম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

কিশলয় রায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজলে দেখা যায়, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর একাধিক ছবি সেখানে পোস্ট করে হয়েছিল। কয়েকটি ছবিতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য এবং তৃণমূল সোশ্যাল মিডিয়া সেলের প্রধান তথা মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্যকে দেখা যায়।

এবিভিপি ও টিএমসিপি-র ছাড়াও, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো, দোল উৎসব আয়োজনের কথা স্বীকার করে নিয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (SFI) যাদবপুর আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারি সৌর্যদীপ্ত রায়। তিনি জানান যে, ইফতার পার্টির পাশাপাশি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সরস্বতী পুজো, দোল উৎসব হয়। যেখানে সমস্ত জাতি-ধর্মের পড়ুয়ারা একসঙ্গে যোগ দেন। ইফতার ও সরস্বতী পুজো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অভিযোগ ছড়াচ্ছে, সেটাকে পুরোপুরি ভুয়ো দাবি বলেছেন তিনি।
News Checker-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার আয়োজক কমিটির একজন সদস্য তথা একজন শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক মহম্মদ সাজ্জাদ হোসেন আনসারির সঙ্গে। তিনি আমাদের বলেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার যেমন হয়, সরস্বতী পুজো-দোলের মতো সমস্ত ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। আমি যেমন ইফতারে অংশগ্রহণ করেছি, তেমনই সরস্বতী পুজোতেও গিয়ে ভোগ খেয়েছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো স্থায়ী ঠাকুরের বিগ্রহ রয়েছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ছড়াচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে।”
এখানেই শেষ নয়, News Checker-এর সঙ্গে সরস্বতী পুজোয় যোগদানের ছবিও শেয়ার করেছেন মহম্মদ সাজ্জাদ হোসেন আনসারি। যেখানে তাঁকে ভোগ খেতে ও পুরোহিতের থেকে আশীর্বাদ নিতে দেখা যাচ্ছে।


এই বিষয়ে আরও জানতে News Checker-এর তরফে যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়ের রেজিস্ট্রার ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়,। তবে সেটা এখনও সম্ভব হয়নি। তাঁর বক্তব্য পেলে, এই প্রতিবেদনটি আপডেট করা হবে।
Conclusion
সমস্ত তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখে এটা স্পষ্ট যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে দাবিটি ছড়িয়েছে সেটা ভুয়ো। কারণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার পার্টির পাশাপাশি, সরস্বতী পুজো, দোল উৎসবও হয়।
Sources
Telephonic conversation with Nikhil Das, ABVP, Jadavpur University
Telephonic conversation with Sanjib Pramanik, TMCP, Jadavpur University
Telephonic conversation with Shourjyadipta Roy, SFI, Jadavpur University
Telephonic conversation with Sajjad Hossain, Department of Education, Jadavpur University
ফ্যাক্ট-চেক এবং সমস্ত আপডেটের জন্য আমাদের WhatsApp চ্যানেল ফলো করুন: https://whatsapp.com/channel/0029Va23tYwLtOj7zEWzmC1Z